• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২০ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ০৫ আগষ্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
  • Govt. SL. No:-352

Advertise your products here

তরুণ রাজনীতির সম্ভাবনা ও সংকট


ডে-নাইট-নিউজ ; প্রকাশিত: সোমবার, ০৪ আগষ্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ০১:২৬ পিএম;
তরুণ রাজনীতির সম্ভাবনা ও সংকট
তরুণ রাজনীতির সম্ভাবনা ও সংকট

তরুণ রাজনীতির সম্ভাবনা ও সংকট – পরিবর্তনের সন্ধানে এক আত্মসমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি.

 .

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে তরুণদের ‘২৪ দফা’র একটি ইশতেহার। ‘নতুন বাংলাদেশের’ স্বপ্ন নিয়ে তারা যে দলীয় পরিকল্পনা তুলে ধরেছে, সেটি নিঃসন্দেহে এক আলোচনার দাবিদার। কিন্তু এই আলোচনার মূল প্রশ্ন ইশতেহার নয়—বরং প্রশ্নটা ভিন্ন। প্রশ্নটা হচ্ছে, রাজনীতির মতো ‘দগ্ধ’ শব্দের প্রতি তরুণ প্রজন্মের যে ঘৃণা, তার নিরসনে কী পথ বেছে নিচ্ছে এই নবীন নেতৃত্ব?.

গণমাধ্যমকে অনেকেই আজকাল ই-আবর্জনা ভাবেন। রাজনৈতিক সংবাদ দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে। রাজধানীর রাজপথে সপ্তাহের শুরুতেই ছাত্রদলের মিছিল কিংবা তরুণদের ‘আদর্শিক’ জটলার নামে জনজীবনের দুর্ভোগ—সবকিছুই যেনো জনমানুষের চোখে ‘মানসিক নির্যাতন’। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাজনীতি আজ সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা হারিয়ে ফেলেছে। কারণ একটাই—রাজনীতির অধিকাংশ অংশ আজ দেশপ্রেম নয়, বরং দলভক্তির জালে বন্দি।.

তরুণদের নতুন ইশতেহারে কিছু উচ্চাশী পরিকল্পনা আছে—শিক্ষা, গবেষণা, প্রযুক্তি, গণমাধ্যম সংস্কার ও কর্মসংস্থানসহ নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শব্দ আর ভাষার কৌশলে যে পরিকল্পনাগুলো লেখা, তার বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার প্রসঙ্গে যেখানে ‘খরচ’ বা ‘বরাদ্দ’ নয়, ‘বিনিয়োগ’ শব্দটি ব্যবহার করার প্রত্যাশা ছিল, সেখানে একই পুরনো কাঠামো দেখে হতাশ হতে হয়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইশতেহার এখন মুখস্ত বিদ্যার মতো—পরীক্ষার খাতায় ভালো নম্বর পাওয়ার মতো সাজানো।.

 .

 .

রাজনীতিতে যাদের সক্রিয় ভূমিকা, তাদের বড় অংশ এখনো মিথ্যা রোমান্টিসিজমে ভোগে—একাত্তর, পঁচাত্তর, দুই হাজার এক, কিংবা দুই হাজার সাত... এসব সাল আর ঘটনার ভেতরেই আটকে আছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। অথচ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, জেনারেশন জেড ও আলফা, জলবায়ু পরিবর্তন, ডিজিটাল অর্থনীতি—এসব নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো গভীর ভাবনা নেই। নেতৃত্বের মানসিকতা এখনো গত শতকের কাঠামোতে। তরুণদের জ্ঞানের গতিশীলতা, প্রযুক্তিনির্ভরতা, আন্তঃসংযোগ এবং মানবিক বোধ—এসব কিছুই উপেক্ষিত।.

যদি প্রশ্ন করা হয়—তাহলে এই দলান্ধ রাজনীতির সমাধান কোথায়? তাহলে উত্তর জটিল হলেও স্পষ্ট: রাজনীতিকে গণমুখী ও তরুণমুখী করতে হলে, সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। পরিবারতন্ত্র আর একনায়কতন্ত্রের ছায়া থেকে মুক্তি ছাড়া দলগুলোর কাঠামোগত সংস্কার সম্ভব নয়। দলীয় আনুগত্য নয়, চিন্তাশীলতা, মেধা, মানবিকতা ও মূল্যবোধ—এসব গুণই হতে হবে নেতৃত্ব নির্বাচনের মাপকাঠি।.

এই প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দলীয় করপোরেট স্বার্থে নয়, বরং নিরপেক্ষ, অনুসন্ধানী, সাহসী সাংবাদিকতা রাজনীতির জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় প্রভাব ফেলতে পারে। বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের ‘নির্বাক পর্যবেক্ষক’ ভূমিকাও বদলাতে হবে। কেউ যদি চিন্তার দাসত্ব না করে সত্য উচ্চারণ করতে পারে, তাহলেই রাজনীতির বদ্ধ জলাশয়ে ঢেউ ওঠে।.

এই সময়ের তরুণদের মধ্যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে—কিন্তু তা সংগঠিত করার মতো প্ল্যাটফর্ম নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো দলীয় রাজনীতির আখড়া। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া মানেই ‘কে কোন দলের, কার বাপ কি করত’—এই প্রশ্নের বেড়াজালে আটকে যাওয়া। অথচ পরিবর্তনের সূচনা এখান থেকেই হওয়া উচিত ছিল। যেখানে তরুণদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ‘চিন্তাশীলতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস’-এর ভিত্তিতে গড়ে উঠতো। আমাদের দরকার এমন একটি ছাত্ররাজনীতি, যেখানে ছাত্রত্ব থাকবে, চাটুকারিতা নয়।.

রাজনীতি থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে—তরুণদের বড় অংশ রাজনীতিকে ঘৃণা করে। কিন্তু এই ঘৃণা যদি সচেতন অংশগ্রহণে রূপান্তরিত না হয়, তাহলে রাজনীতি থেকে ‘মূর্খ’ আর ‘অথর্ব’দের সরানো যাবে না। তরুণদের রাজনীতিতে আসতে হবে—কিন্তু তা কোনো দলের পেইড ট্রল হয়ে নয়। তাদের আসতে হবে আগুনঝরা বুকে, সাহসী মননে, মানবিক চিন্তায়। যেসব তরুণ ক্যান্টিনে চাঁদা না দিয়ে দিন চালায়, যারা বাবার ফুটপাথের ব্যবসার টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে—তাদের হাতেই থাকতে হবে দেশের ভবিষ্যৎ।.

এই জায়গায় এসে মনে হয়, তরুণ রাজনীতিকদের উচিত ‘রাজনীতির ভাষা’ বদলানো। অতীতের গৌরবের গল্প নয়, দরকার ভবিষ্যতের রূপরেখা। ‘যুদ্ধ করেছি’—এই বাক্য দিয়ে আর যন্ত্রণা দূর হয় না। যুদ্ধের চেয়ে কঠিন এখন প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি, কর্মসংস্থানের দায়, জলবায়ু সংকট, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা। যারা এই বিষয়গুলো বোঝে না, তারা শুধু নির্বাচনের ভাষণেই ভালো, দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে নয়।.

সর্বশেষে বলতে হয়, ‘ইশতেহার’ কেবল পরিকল্পনার দলিল নয়। এটি বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রতিশ্রুতির প্রকাশ। তরুণদের ২৪ দফা ভালো উদ্যোগ, কিন্তু তা যেন আরেকটি মুখস্তপাঠে পরিণত না হয়। পরিবর্তনের আশ্বাস নয়, পরিবর্তনের প্রস্তুতি জরুরি।.

 .

 .

আমাদের এই রাজনৈতিক অন্ধকারে একমাত্র আশার আলো হলো সচেতন, চিন্তাশীল, মানবিক তরুণরা—যারা বলবে, “বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুকে পেতেছি, গুলি কর”। কারণ দেশ পরিবর্তনের সাহসিকতা আসে ভয়ের অতীত নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি থেকে।.

 .

লেখক: শফিউল বারী রাসেল, (কবি, গীতিকার, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষক) . .

ডে-নাইট-নিউজ /

সম্পাদকীয় বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ