
.
ইরান, এক বিশাল ইতিহাস ও প্রাচীন সভ্যতার দেশ, যার অস্তিত্ব ও অটলতা কেবল রাজনীতি বা কৌশলের ভিত্তিতে নয়, বরং তার ভৌগোলিক কাঠামো, সাংস্কৃতিক আত্মচেতনা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে গঠিত। ইরানকে অনেকেই বলে থাকেন ‘অজেয় দূর্গ’ বা 'প্রাকৃতিক দূর্গ', আবার অনেকে বলেন, “ঈশ্বরপ্রদত্ত এক অবিনাশী শক্তি"। এই ধারণা নিছক আবেগ বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আসেনি বরং এর পেছনে রয়েছে ভূগোল, ইতিহাস, কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা এবং এক অদম্য জাতীয় চেতনার গভীর সংমিশ্রণ। ইতিহাসের ধারায় বহুবার আক্রমণের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও ইরান বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, যার মূল কারণ খুঁজলে দেখা যাবে—এটি একদিকে যেমন ভৌগোলিকভাবে সুরক্ষিত, তেমনি আত্মিকভাবে এক বলিষ্ঠ জাতির প্রতিনিধিত্ব করে। এই প্রবন্ধে ইরানের অজেয়তার পেছনের ভৌগোলিক, ইতিহাসগত এবং প্রতিরক্ষা কৌশলগত দিক বিশ্লেষণ করা হলো একাডেমিক তথ্য ও আন্তর্জাতিক রেফারেন্সসহ।.
.
১. প্রাকৃতিক দূর্গ: ভূগোলই ইরানের সবচেয়ে বড় বডিগার্ড.
ইরানের ভূপ্রকৃতি পৃথিবীর অন্যতম প্রতিরক্ষামূলক অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। চারপাশে বিস্তৃত পাহাড়, মরুভূমি ও উপত্যকা মিলে এটি এক প্রাকৃতিক দুর্গে পরিণত হয়েছে।.
.
পশ্চিমে জাগরোস পর্বতমালা (Zagros Mountains): ইরানের পশ্চিমে ইরাক সীমান্ত ঘেঁষে প্রায় ১,৫০০ কিমি বিস্তৃত জাগরোস পর্বতমালা প্রাচীনকাল থেকেই একটি প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা দেয়াল হিসেবে কাজ করে আসছে। এই পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে কোনো আধুনিক সেনাবাহিনীর প্রবেশ যেমন কঠিন, তেমনি এটি গেরিলা প্রতিরোধের জন্যও আদর্শ।.
.
উত্তরে এলবুর্জ পর্বতমালা (Alborz Mountains): কাস্পিয়ান সাগরের তীর ঘেঁষে এলবুর্জ পর্বতশ্রেণি অবস্থিত। এই পর্বতমালায় রয়েছে ইরানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট দামাভান্দ, যা ৫,৬৭১ মিটার উঁচু। এই অঞ্চল তুষারপাতে ঢাকা এবং কৌশলগত গতিবিধি সীমিত করে দেয়।.
.
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে দাশতে লুত ও দাশতে কাবির (Dasht-e Lut and Dasht-e Kavir): দাশতে কাবির ও দাশতে লুত —নামে দুটি বিশাল মরুভূমি এই অঞ্চলে অবস্থিত। যা বিশ্বের অন্যতম শুষ্ক মরুভূমি। ২০০৫ সালে নাসার স্যাটেলাইট গবেষণায় দাশতে লুৎ-কে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ স্থান হিসাবে চিহ্নিত করা হয় (তাপমাত্রা: ৭০.৭° সেলসিয়াস)। এই স্থান দুটি একাধারে জনমানবহীন এবং চরম আবহাওয়ার অধিকারী, যেখানে কোনো বাহিনীর স্থায়ী অবস্থান বা বড় আকারের আক্রমণ প্রায় অসম্ভব।.
.
পূর্ব দিকে পার্বত্য ও বালুকাময় অঞ্চল: আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্ত ধরে বিস্তৃত পার্বত্য ও মরুভূমি অঞ্চল ইরানকে পূর্ব দিক থেকেও সুরক্ষিত রাখে।.
.
এইভাবে ইরান যেনো একটি প্রাকৃতিক ‘ফোর্ট নক্স’—যেখানে ভূগোল নিজেই একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।.
.
২. ইতিহাসের শিক্ষা: প্রতিরোধের ঐতিহ্য.
ইরানের ইতিহাস প্রতিরোধ ও আত্মমর্যাদার এক দীর্ঘগাথা। হাজার বছরের ইতিহাসে পারস্য সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার বহন করা ইরান একের পর এক বিদেশি আগ্রাসন ও বারবার বহিরাগতদের আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়েও প্রতিবারই সাংস্কৃতিকভাবে টিকে থেকেছে.
মাথা উঁচু করে।.
.
গ্রিক, আরব, মঙ্গোল ও ব্রিটিশ আগ্রাসন—প্রতিটি সময়েই ইরান তার সংস্কৃতি, ভাষা ও আত্মপরিচয় ধরে রেখেছে।.
.
মঙ্গোল আক্রমণ (13th Century): হুলাগু খানের আগ্রাসনে বহু শহর ধ্বংস হয়, তবুও পার্সি সভ্যতা রয়ে যায় অবিচল।.
.
১৯৫৩ সালের সিআইএ সমর্থিত অভ্যুত্থান: নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন তেল-স্বার্থে শাহকে পুনঃস্থাপন করে —যা ছিল ইরানের উপর আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবের একটি দৃষ্টান্ত।.
.
ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮): মার্কিন ও আরব সমর্থনে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক ইরানের উপর যুদ্ধ চাপায়। প্রায় ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। যেখানে ইরান একদম একা ছিল বিশ্বের প্রায় সব শক্তিধর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। তবুও ইরান টিকে যায়, পরাস্ত হয়নি।.
.
এইসব যুদ্ধ ও সংকট থেকে ইরান শুধু টিকেই থাকেনি, বরং প্রতিবার আরও বেশি আত্মনির্ভর হয়েছে।.
.
৩. আত্মিক শক্তি ও প্রতিরোধ এবং ধর্মীয় চেতনা.
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, ইরান শুধুমাত্র অস্ত্র, পর্বত বা কৌশলে অজেয় নয়; বরং এর মূল শক্তি মানুষের বিশ্বাস ও জাতীয় ঐক্যে। ইরানের জনগণ ধর্মীয়ভাবে শিয়া মতবাদের অনুসারী। এই মতবাদে শহীদতত্ত্ব (Martyrdom Ideology) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা ইতিহাসে বরাবরই নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক সংগ্রামী চেতনার প্রতীক।.
.
কারবালা ও ইমাম হুসেইনের শাহাদাত ইরানি সমাজে আত্মত্যাগের মূল আদর্শ হিসেবে কাজ করে। শাহাদাত বা আত্মত্যাগের সংস্কৃতি এই জাতির রক্তে মিশে গেছে। কারবালার ইতিহাসকে তারা কেবল ধর্মীয় ঘটনা হিসেবে নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক নৈতিক প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখে।.
.
আত্মনিয়ন্ত্রণের ধারণা — “ইস্তেকলাল ও আজাদেগি” (স্বাধীনতা ও মুক্তি) ইরানি রাজনীতির মূলমন্ত্র।.
.
এই আত্মিক দৃঢ়তা যে কোনো অস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী। এটি এমন এক মনোবল তৈরি করে, যার কারণে জাতি হয়ে ওঠে অদম্য।.
.
৪. আধুনিক প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা.
ইরান তার ভূগোল এবং আত্মিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছে এক আধুনিক প্রতিরক্ষা কাঠামো।.
.
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রযুক্তি: ইরান এখন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ। তারা কৌশলগত ব্যালান্স বজায় রাখে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের মতো শত্রুদের বিরুদ্ধে। এছাড়া তাদের ঘরোয়া প্রযুক্তিতে তৈরি ড্রোন মধ্যপ্রাচ্যে নজরদারি ও হামলার কৌশলে বড় ভূমিকা রাখছে।.
.
সাইবার যুদ্ধ: ২০১০ সালে ইরানের পরমাণু কেন্দ্রের উপর Stuxnet সাইবার হামলা হয়, কিন্তু এরপর ইরান নিজস্ব সাইবার প্রতিরক্ষা ইউনিট গড়ে তোলে। ইরান এখন সাইবার নিরাপত্তা ও আক্রমণ দুই দিকেই বিশ্বে পরিচিত নাম। .
.
প্রক্সি ও আঞ্চলিক প্রভাব: হিজবুল্লাহ (লেবানন), হুতি বিদ্রোহী (ইয়েমেন), শিয়া মিলিশিয়া (ইরাক)—এই সমস্ত গোষ্ঠীর মাধ্যমে ইরান তার নিরাপত্তা বেল্টকে সীমান্তের বাইরে সম্প্রসারিত করেছে। একে বলা হয় “ফরোয়ার্ড ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজি”।.
.
৫. আধ্যাত্মিক বিশ্বাস বনাম আধিপত্যবাদ.
"God is Iran’s bodyguard"—“ইরানের বডিগার্ড স্বয়ং মহান সৃষ্টিকর্তা”—এই উক্তিটি অনেকের কাছে ধর্মীয় আবেগ হলেও বাস্তবতা নির্ভর এক প্রতিরক্ষা দর্শন। দেশটির রাষ্ট্রদর্শনের মূলমন্ত্র: “Neither East nor West, but Islamic Republic” (না পূর্বের অধীন, না পশ্চিমের—আমরা ইসলামী প্রজাতন্ত্র)। ইরান প্রকৃতির হাতে গড়া এক সুরক্ষিত মানচিত্র, আত্মত্যাগের ঐতিহ্য, এবং ঈশ্বর বিশ্বাসে দৃঢ় মানুষ—এইসবই মিলে ইরানকে এক অনন্য শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।.
.
বিশ্ব রাজনীতিতে ইরানকে দুর্বল বা পরাজিত করার চেষ্টা বহুবার হলেও সফলতা আসেনি। এটি যেনো বারবার প্রমাণ করে—যে জাতির আত্মবিশ্বাস পাহাড়ের চেয়েও দৃঢ় এবং যে দেশের চারপাশে প্রকৃতি নিজেই প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাকে কেবল যুদ্ধের ময়দানে নয়, মনোবলের যুদ্ধে জয় করাও প্রায় অসম্ভব।.
.
ইরান নিছক একটি দেশ নয়—এটি ইতিহাস, ভূগোল, ধর্মীয় চেতনা, আত্মত্যাগ এবং প্রতিরোধের এক জীবন্ত নিদর্শন। পশ্চিমা আধিপত্যবাদী চেষ্টাগুলোর বিপরীতে ইরান দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো—যার শেকড় খুব গভীরে, আর শাখা চারদিকে বিস্তৃত। পাহাড়, মরুভূমি ও বিশ্বাসে গড়ে উঠা এই জাতিকে সামরিক শক্তি দিয়ে দমন করা কঠিন শুধু তার অস্ত্রাগারের কারণে নয়, বরং তার আত্মচেতনার কারণে। ইরান হলো সেই রাষ্ট্র, যাকে পৃথিবীর ইতিহাস আজও পরাস্ত করতে পারেনি কেউ। আজকের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইরান শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ—স্বাধীনতা, আত্মরক্ষা ও জাতিগত গৌরব কীভাবে বজায় রাখা যায়, তার এক বাস্তব উদাহরণ।.
.
লেখক: শফিউল বারী রাসেল, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক .
.
তথ্যসূত্র: .
1. National Geographic Atlas of the World, 10th Edition.
2. Geological Society of America, “Tectonic Framework of Iran,” 2018.
3. NASA Earth Observatory, “World's Hottest Land Surface Temperatures,” 2005.
4. Peter Jackson, The Mongols and the Islamic World, Yale University Press, 2017.
5. Stephen Kinzer, All the Shah’s Men, Wiley, 2003.
6. International Institute for Strategic Studies (IISS), “The Iran-Iraq War: Lessons Unlearned,” 2002.
7. Hamid Dabashi, Shi’ism: A Religion of Protest, Harvard University Press, 2011.
8. RAND Corporation, “The Rise of Iran’s Soft Power in the Middle East,” 2009.
9. Missile Defense Project, 2023.
10. International Institute for Strategic Studies (IISS), “Drone Proliferation and Iran,” 2022.
11. David E. Sanger, "Confront and Conceal", Crown Publishing, 2012.
12. Brookings Institution, “Iran’s Regional Influence,” 2019.
13. Ayatollah Khomeini, "Sahifeh-ye Imam", Vol. 21. .
ডে-নাইট-নিউজ / || শফিউল বারী রাসেল ||
আপনার মতামত লিখুন: