• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৩ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ০৭ আগষ্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
  • Govt. SL. No:-352

Advertise your products here

আগস্টের ধাক্কা একটি রাজনৈতিক আত্মজিজ্ঞাসা ও মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা


ডে-নাইট-নিউজ ; প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ০৭ আগষ্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ০৪:২০ পিএম;
আগস্টের ধাক্কা একটি রাজনৈতিক আত্মজিজ্ঞাসা ও মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা
আগস্টের ধাক্কা একটি রাজনৈতিক আত্মজিজ্ঞাসা ও মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা

আগস্টের ধাক্কা: একটি রাজনৈতিক আত্মজিজ্ঞাসা ও মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা.

 .

৫ আগস্ট—এটি আর এখন কেবল একটি তারিখ নয়। এটি যেনো আত্মসমালোচনার এক অনিবার্য দিন। একটি শাসক দল যখন বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকে, তখন তার শত্রুর সংখ্যাও বাড়ে, কিন্তু সেই সঙ্গে তার বন্ধু হারানোর সংখ্যাও যদি বাড়তে থাকে—তবে তা নিছক রাজনৈতিক নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক এবং আদর্শিক দুর্ভিক্ষের ইঙ্গিত দেয়। এই ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—শত্রুদের চেয়ে বন্ধু হারানোর যন্ত্রণা কত গভীর।.

 .

আওয়ামী লীগ, যে দলটি এদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছে, দেশের প্রতিটি প্রান্তে যাদের রক্ত-ঘাম-মেধার অবদান রয়েছে, সেই দলটি আজ কেনো এতটা নিঃসঙ্গ? কেনো বিগত ৫-৬ বছর ধরে দলীয় গণ্ডির বাইরে আর কোনো সত্যিকারের বন্ধু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? প্রশ্নটা কঠিন, কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।.

 .

একটি দল তখনই বড় হয়, যখন তার পাশে শুধু দলীয় অনুসারীরা নয় বরং ভিন্নমতাবলম্বী, প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী ও সাধারণ মানুষও বিশ্বাসের জায়গা থেকে দাঁড়ায়। আজ সেই জায়গাটা শূন্য। দলীয় পদ-পদবীর মোহে যাদেরকে বন্ধু ভাবা হয়েছে, তারা হয়ত পাশেই ছিলো, কিন্তু প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীরা ধীরে ধীরে সরে গেছেন—ক্ষমতার উত্তাপে দগ্ধ হয়ে, অবহেলায় অবমাননায় পিষ্ট হয়ে।.

 .

 .

সুলতানা কামালের মতো মানুষের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তা শুধুই তার প্রতি নয়, তা ছিল এক ধরনের প্রবণতা—"শুধু যারা প্রশংসা করবে, তারা থাকবে, যারা প্রশ্ন তুলবে তারা শত্রু।" অথচ সুলতানা কামাল ছিলেন সেই কণ্ঠ, যিনি ২০০৭ সালে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাহসিকতার প্রতীক হয়েছিলেন। সেই কণ্ঠকেও অবমূল্যায়ন করে আওয়ামী লীগ শুধু তাকে নয়, নিজেদের আদর্শকেও খাটো করেছে।.

 .

আওয়ামী লীগ বুঝে উঠতে পারেনি, সমাজে এমন একটি শ্রেণি আছে—যারা দলীয় না হয়েও, মানুষের কষ্টে ব্যথিত হয়, অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করে। তারা দল চায় না, চায় সত্য। অথচ আওয়ামী লীগ তাদেরও শত্রু বানিয়ে ফেলেছিলো। এর পরিণতি আজ তাদের চারপাশেই— সংস্কৃতিকর্মী থেকে শুরু করে প্রগতিশীল রাজনীতিক, এমনকি তাদের দীর্ঘদিনের সঙ্গীরাও আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।.

 .

 .

ইউনুস সরকারের বিরুদ্ধে যখন কেউ মুখ খুলছে না, তখন যে ক'জন "অবন্ধু" সাহস করে কথা বলছেন, আজ তাদের কথাই লাইক-কমেন্ট- শেয়ারে ছড়িয়ে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। অথচ এক সময় তাদের সাথে মঞ্চ ভাগ করতেও তাদের অনীহা ছিল প্রবল। এখন সেই কণ্ঠগুলোই হয়ে উঠেছে তাদের অন্তর্নিহিত সংকটের আয়না। যদি সময় থাকতে তাদের কথা শোনা হতো, তাহলে হয়তো আওয়ামী লীগকে এদিন দেখতে হতো না।.

 .

শুধু তাই নয়; আওয়ামী লীগ সুশীল সমাজকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে, ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তরুণদের ব্যথাকে অপমান করেছে, মুক্তচিন্তার জায়গাগুলো দখলে নিয়েছে, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরকে রাজনীতির লেবেল দিয়ে সংকুচিত করেছে, আইন করে সাংবাদিকদের কলম থামিয়ে দিয়েছে । তারা বন্ধু খুঁজেছে ঠিকই, কিন্তু বন্ধুত্বের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।.

 .

তরুণদের কথা বলি। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দিয়ে যাদের হাত শক্ত করা হলো, তাদেরকেই আওয়ামী লীগ হয়তো বুঝাতে পারেনি—তোমরা এ জাতির ভবিষ্যৎ। আওয়ামী লীগ শুধু প্রযুক্তি দিয়েছে, কিন্তু তাদের মনের কথা শোনেনি। তাদের যে নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব ক্ষোভ, নিজস্ব প্রতিবাদ আছে—তা বোঝার চেষ্টা করেনি। যখন তারা প্রতিবাদে নামে, আওয়ামী লীগ বলেছিল: "তোমরা শত্রু"। অথচ তারা চেয়েছিল—দলটি যেনো নিজেদের ভুল শুধরে নেয়।.

 .

শুধু বিরোধীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। নিজের ভেতরের ফাটলগুলোও দেখতে হবে। উদীচী, কমিউনিস্ট পার্টি, বাম সংগঠন, পেশাজীবী পরিষদ, জাতীয় পার্টি—এরা সবাই যখন একসাথে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন সেটা নিছক কোনো ষড়যন্ত্র নয় বরং এটি সমাজের মনস্তত্ত্বে জমে থাকা অবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। আওয়ামী লীগ কি নিজেদের দিকে ফিরে তাকাবে না?.

 .

আজকের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন শুধু বিভাজন নয়, এটা একটি গৃহবিবাদের প্রতিচ্ছবি। .

 .

গত বছর ছাত্র-জনতা আন্দোলনে  আওয়ামী লীগের ভেতরের অনেক সন্তান রাজপথে ছিলো, আর পিতামাতা ছিলো গণভবনে। এই চিত্র হৃদয়বিদারক, কিন্তু বাস্তব। নিজের ঘর ভেঙে গেলে বাইরের দুর্গ টিকিয়ে রাখা যায় না। introspection—আত্মজিজ্ঞাসা—এখন সময়ের দাবি।.

 .

৫ আগস্টের মত দিন আমাদের শেখায়, উন্নয়ন দিয়ে সব কিছু ঢাকা যায় না। গণতন্ত্র, শ্রদ্ধা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের সহনশীলতা— এই মূল্যবোধগুলো হারিয়ে গেলে, উন্নয়ন একসময় মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে।.

 .

হাসিনা পতন আন্দোলনে ডলার ছড়ানোর কথা উঠেছে। হ্যাঁ, সেই আন্দোলনে হয়তো বিদেশী অর্থ ছিলো। কিন্তু সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে আওয়ামী লীগের  উপেক্ষা, অহংকার ও গোঁড়ামি। সময় এসেছে তাদের নিজেদের ভুল খুঁজে বের করার। আত্মসমালোচনা কেবল আত্মধ্বংস নয়—বরং পুনর্গঠনের পূর্বশর্ত।.

 .

আজ যারা আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে গেছেন, তাদেরকে আবার পাশে পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সম্মান দিয়ে, সাহস দিয়ে, অংশীদারিত্বের সুযোগ দিয়ে। আর না হলে, তাদের চারপাশেই শুধু শত্রু থাকবে—কিন্তু প্রকৃত বন্ধুরা, তারা থাকবে না। আর একা কেউ বেশিদিন টিকতে পারে না।.

 .

এই আত্মজিজ্ঞাসার শুরু হোক আজ থেকেই—৫ আগস্টের তীব্র রক্তক্ষরণের পর।.

 .

লেখক: শফিউল বারী রাসেল (কবি, গীতিকার, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষক).

 . .

ডে-নাইট-নিউজ /

সম্পাদকীয় বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ