
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে, জানিয়েছেন ট্রাম্প: আসল বাস্তবতা কি? ভবিষ্যৎ কোন পথে!
.
যুদ্ধের আবির্ভাব
২০২৫ সালের এপ্রিলে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে বহু বছর ধরে জমে থাকা উত্তেজনা আচমকাই পূর্ণমাত্রার সংঘাতে রূপ নেয়। সিরিয়া ও গাজা সীমান্তকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া হামলা পাল্টা-হামলার ঘটনা রূপ নেয় সরাসরি রাষ্ট্রীয় যুদ্ধের।.
.
ইসরাইল দাবি করে, ইরান তার মিত্র মিলিশিয়াদের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে হামলা করছে। অপরদিকে, ইরান জানায়, তারা প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে “সায়োনিস্ট আগ্রাসনের” প্রতিক্রিয়ায়।.
১২ দিনের ভয়াবহ সংঘর্ষে নিহত হয় অন্তত ৪২০০ জন, যার মধ্যে সাধারণ নাগরিকের সংখ্যাই বেশি। ইসরাইলি বিমান হামলায় ইরানের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র লক্ষ্যবস্তু হয়, অন্যদিকে ইরানও ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়ে ইসরাইলের তেল আবিব, হাইফা এবং বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর আক্রমণ করে।.
.
ট্রাম্পের ঘোষণাঃ যুদ্ধবিরতির আকস্মিক বার্তা
২০২৫ সালের ২৩ জুন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প Truth Social-এ এক বিবৃতিতে দাবি করেন:.
“ইরান ও ইসরাইল সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।”.
তিনি দাবি করেন, তাঁর মধ্যস্থতায় দুই দেশ ১২ ঘণ্টার জন্য অস্ত্রবিরতি রাখবে এবং তারপর সেটা স্থায়ী চুক্তিতে রূপ নেবে। বিশ্ব গণমাধ্যমে এ সংবাদ রীতিমতো ঝড় তোলে।.
বাস্তবতা কি এতটা সরল?
তবে ট্রাম্পের ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে ভিন্ন বার্তা আসে।.
ইরানের অবস্থান:
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি স্পষ্ট করে বলেন, “এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, তবে ইসরাইলের আগ্রাসন না থামলে আমাদের হাত বাঁধা থাকবে না।”.
ইরান ইঙ্গিত দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা উপেক্ষা করে তারা নিজস্ব সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবে।.
ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া:
ইসরাইল সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতির স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।.
প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউয়াভ গ্যালান্ট এক বিবৃতিতে বলেন, “যদি ইরান একটিও মিসাইল ছোড়ে, আমরা ১০টি জবাব দেব।”.
যুদ্ধ কি সত্যিই থেমেছে?
ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাস্তবতা ভিন্ন দৃশ্যপট তুলে ধরে:.
ইরান থেকে ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বেজারশেভাতে আঘাত হানে; ৪ জন নিহত।.
ইসরাইল গাজা সীমান্তে নতুন করে ড্রোন হামলা চালায়; অন্তত ১৭ জন নিহত, যার মধ্যে ৭ জন শিশু।.
মার্কিন ঘাঁটি কাতারে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদিও ট্রাম্প দাবি করেছিলেন “ইরান আমাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিল তারা হামলা করতে যাচ্ছে।”.
.
যুদ্ধবিরতির পেছনের কূটনীতি
ট্রাম্প দাবি করেছেন যে তাঁর “অফ দ্য রেকর্ড” কথোপকথন ইরান ও ইসরাইলকে একসাথে টেবিলে বসাতে সক্ষম হয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক কূটনীতিকেরা এই দাবি ‘অতিরঞ্জিত’ বলে মনে করছেন।.
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান আপাতত কৌশলগত বিরতি চায়, কারণ দেশটির অর্থনীতি কঠিন পরিস্থিতিতে রয়েছে।.
ইসরাইল চায় যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে মার্কিন সহায়তা নিশ্চিত রাখা এবং আন্তর্জাতিক চাপ হ্রাস করা।.
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ সাধারণভাবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা স্বাগত জানায়, তবে বলেছে “সেটি বাস্তবায়িত না হলে এর অর্থহীনতা প্রকাশ পাবে।”.
রাশিয়া ও চীন ট্রাম্পের মধ্যস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। চীন বলেছে, “একতরফা ঘোষণা দিয়ে শান্তি আসে না।”.
ইউরোপীয় ইউনিয়ন দুই পক্ষের প্রতি সংযমের আহ্বান জানায়।.
.
ভবিষ্যৎ কোন পথে?
এই ঘোষণাকে নিছক রাজনৈতিক নাটক বলেই মনে করছেন অনেকে। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, সংঘাত এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে।.
তিনটি সম্ভাব্য পথ রয়েছে:
১. স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও কূটনৈতিক সমঝোতা: যদি ট্রাম্প বা অন্য কোনও শক্তিধর রাষ্ট্র মধ্যস্থতা করতে পারে, এবং উভয় দেশ রাজনৈতিকভাবে চাপ অনুভব করে, তবে যুদ্ধবিরতি দীর্ঘায়িত হতে পারে।.
২. অঘোষিত যুদ্ধ অব্যাহত: যুদ্ধবিরতির আড়ালে সীমিত আকারে প্রতিহিংসামূলক হামলা চালিয়ে যেতে পারে দুই পক্ষ। মিডিয়া থেকে দূরে এমন যুদ্ধকে ‘ছায়া সংঘাত’ বলা হয়।.
৩. সম্পূর্ণ যুদ্ধের বিস্তার: যদি কোনো বড় হামলায় উচ্চপদস্থ ব্যক্তি নিহত হয় বা কোনো পরমাণু কেন্দ্র ধ্বংস হয়, তবে সরাসরি যুদ্ধ আবারও জ্বলে উঠবে—এবার হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাও ঘটতে পারে।.
.
উপসংহার
ডোনাল্ড ট্রাম্পের “পূর্ণ যুদ্ধবিরতির” ঘোষণা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ হলেও মাঠের বাস্তবতায় এটি এখনো কাগুজে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য শুধুমাত্র ঘোষণা যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন বিশ্বাসযোগ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, পারস্পরিক আত্মবিশ্বাস ও আন্তর্জাতিক শক্তির দায়বদ্ধতা।.
পরিশেষে বলা যায়, যুদ্ধবিরতির এই নাটকীয় ঘোষণার পেছনে অনেক অনিশ্চয়তা লুকিয়ে আছে। এখন সময় এসেছে ঘোষণার বাইরে গিয়ে বাস্তব শান্তির পদক্ষেপ নেওয়ার। অন্যথায় এই সংঘাত বিশ্বশান্তির উপর দীর্ঘস্থায়ী ছায়া ফেলতে পারে।.
.
লেখক : শফিউল বারী রাসেল (সাংবাদিক ও প্রবন্ধিক). .
ডে-নাইট-নিউজ / || শফিউল বারী রাসেল ||
আপনার মতামত লিখুন: