
.
.
বাংলাভাষার ইতিহাস ও বিস্তার: বাংলা বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ভাষা। বর্তমানে প্রায় ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে।.
বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ।.
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে ১০ কোটির বেশি মানুষ।.
এছাড়া ঝাড়খণ্ড, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, বিহার ও উড়িষ্যার বিভিন্ন অঞ্চলেও উল্লেখযোগ্য বাঙালি জনগোষ্ঠী রয়েছে।.
প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায়ও পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, কাতার, ইতালি, মালয়েশিয়া ও কানাডায়।.
এই বিপুল সংখ্যক মানুষ বাংলাকে শুধু মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করছে না, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু রাজনৈতিক সীমানা ও রাষ্ট্রীয় বিভক্তির কারণে বাংলা ভাষার ঐক্যবদ্ধ বিকাশ বাধাগ্রস্ত।.
অবিভক্ত বাংলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: বাংলা একসময় একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা ছিল।.
নবাব আলীবর্দী খাঁ ও সিরাজউদ্দৌলার আমলে বাংলা ছিল স্বাধীন প্রদেশ।.
ঔপনিবেশিক যুগে, বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় বাংলাকে বিভক্ত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশ এবং পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অংশ হয়।.
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশে’ পরিণত হয়।.
এই বিভাজনের ফলে বাঙালি জাতি রাজনৈতিকভাবে তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হয়—বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা/আসাম। অথচ ভাষা ও সংস্কৃতিতে তারা একই সত্তার উত্তরাধিকারী।.
ভাষার মর্যাদা ও বিভক্তির সমস্যা: রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে ভাষার ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।.
১. বাংলাদেশে বাংলা রাষ্ট্রভাষা ও সরকারি ভাষা হিসেবে মর্যাদা পেলেও ইংরেজি আধিপত্য এখনও প্রবল।.
২. ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যে হিন্দির চাপ বাড়ছে; কেন্দ্রীয় নীতির কারণে বাংলা প্রান্তিকায়িত হচ্ছে।.
৩. ত্রিপুরা ও আসামে বাংলা ভাষা সাংস্কৃতিক নিপীড়নের শিকার, অনেক জায়গায় বাংলা লিপি ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।.
এই প্রেক্ষাপটে গ্রেটার বাংলাদেশ বা অবিভক্ত বাংলার ধারণা শুধু রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ঐক্যের দাবিও।.
গ্রেটার বাংলাদেশের ধারণা: “গ্রেটার বাংলাদেশ” শব্দগুচ্ছ সাধারণত একটি সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ঐক্যের স্বপ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর উদ্দেশ্য—.
বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে এক ছাতার নিচে আনা।.
ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও বিস্তার নিশ্চিত করা।.
শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমে বাংলার ব্যবহার বৃদ্ধি করা।.
আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলা ভাষাকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া।.
কেন সময়ের দাবি?: .
১. ভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় ঐক্য জরুরি:
গ্লোবালাইজেশনের চাপে ছোট ভাষাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ভাষা হলেও হিন্দি, ইংরেজি ও অন্যান্য প্রভাবশালী ভাষার চাপের মুখে দুর্বল হতে পারে। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া এ ভাষার মর্যাদা ধরে রাখা কঠিন।.
২. অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা:
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে যদি একটি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মঞ্চ তৈরি হয়, তবে বাংলা ভাষা হবে প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম। এতে সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলা ভাষার প্রভাব বাড়বে।.
৩. রাজনৈতিক বিভাজন অতিক্রমের প্রয়োজন: বাঙালি জাতির অভিন্ন ইতিহাস, মুক্তির সংগ্রাম, সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐক্য রাজনৈতিক বিভাজনকে অতিক্রম করে এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক জাতিসত্তা গড়ে তুলতে পারে।.
৪. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি শক্তিশালী করা: বাংলা ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের ৮ম সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা। একে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে কাজের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে গ্রেটার বাংলাদেশ ভাবনার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস প্রয়োজন।.
অবিভক্ত বাংলা: কেমন হতে পারে?: অবিভক্ত বাংলার ধারণা বাস্তবায়নের বিভিন্ন পথ থাকতে পারে—.
সাংস্কৃতিক ঐক্য: যৌথ সাহিত্য উৎসব, চলচ্চিত্র উৎসব, সংগীতানুষ্ঠান, নাটক ও শিল্পমেলায় সীমান্তের উভয়পারের বাঙালির অংশগ্রহণ।.
শিক্ষা ও গবেষণা: দুই বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমঝোতা চুক্তি, গবেষণা বিনিময়, পাঠ্যবইয়ের সামঞ্জস্য।.
অর্থনৈতিক জোট: আঞ্চলিক বাণিজ্য, পর্যটন উন্নয়ন, যৌথ শিল্পাঞ্চল।.
ভাষানীতি সমন্বয়: সরকারি ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার বাড়ানো এবং প্রযুক্তি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলা সহজীকরণ।.
চ্যালেঞ্জ: তবে গ্রেটার বাংলাদেশ বা অবিভক্ত বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে—.
১. রাজনৈতিক বাধা: ভারত ও বাংলাদেশের পৃথক রাষ্ট্রীয় নীতি, কূটনৈতিক ভারসাম্য।.
২. জাতীয়তাবাদী সংবেদনশীলতা: উভয় দেশের জনগণই সার্বভৌমত্বে সংবেদনশীল, ফলে সরাসরি রাজনৈতিক একীভবন সম্ভব নয়।.
৩. অর্থনৈতিক বৈষম্য: উন্নয়নের পার্থক্য ঐক্য গঠনে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।.
৪. ভাষার ভেতর বিভাজন: আঞ্চলিক উপভাষা ও উচ্চারণ পার্থক্য অনেক সময় একধরনের মানসিক দূরত্ব তৈরি করে।.
করণীয়: গ্রেটার বাংলাদেশ বা অবিভক্ত বাংলা সরাসরি রাজনৈতিক একীকরণের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত ঐক্যের মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্ভব।.
দুই বাংলার সাহিত্যিক, শিল্পী ও শিক্ষাবিদদের নিয়মিত মতবিনিময়।.
বাংলা ভাষায় প্রযুক্তি ও ডিজিটাল কনটেন্ট বৃদ্ধি।.
তরুণ প্রজন্মকে বাংলাভাষার গৌরব সম্পর্কে সচেতন করা।.
আঞ্চলিক সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম তৈরি।.
উপসংহার: ভাষা আমাদের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রাজনৈতিক সীমানার দেয়াল ভাঙা না গেলেও সাংস্কৃতিক ও ভাষাগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি। গ্রেটার বাংলাদেশ বা অবিভক্ত বাংলার স্বপ্ন আমাদের ভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। ১৯৫২ ও ১৯৭১-এর ত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বাংলার প্রশ্নে আপোস নয়, বরং ঐক্যই হলো শক্তি। তাই আগামী প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাকে আরও মর্যাদাবান ও বিশ্বজনীন করে তুলতে হলে এখনই প্রয়োজন এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক বাংলার দিগন্ত উন্মোচন।.
.
লেখক: শফিউল বারী রাসেল (কবি, গীতিকার, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষক) . .
ডে-নাইট-নিউজ /
আপনার মতামত লিখুন: