• ঢাকা
  • বুধবার, ৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ১৮ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
  • Govt. SL. No:-352

Advertise your products here

ইরান–ইসরায়েল সংঘাতের পরিণতি একটি অনিবার্য বিপর্যয়


ডে-নাইট-নিউজ ; প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ০১:৫৮ পিএম;
ইরান–ইসরায়েল,  সংঘাতের পরিণতি,  একটি অনিবার্য বিপর্যয়
ইরান–ইসরায়েল সংঘাতের পরিণতি একটি অনিবার্য বিপর্যয়

 .

"একটি আঞ্চলিক লড়াই এখন বৈশ্বিক উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দু। যুদ্ধ শুধু সীমান্তে আটকে নেই—তা নীতিনির্ধারকদের টেবিল কাঁপাচ্ছে, তেলের বাজার উত্তাল করছে এবং মানব সভ্যতার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।".

 .


 .

সংঘাতের উৎস: ইতিহাস ও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম জটিল ও পুরনো বিরোধ ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আদর্শভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি এবং ইসরায়েলের জাতিগত নিরাপত্তাভিত্তিক রাষ্ট্রনীতি দু’টি ভিন্ন মেরু তৈরি করেছে। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর থেকেই তেহরান ‘ইসরায়েল-বিরোধী’ অবস্থানকে তাদের পররাষ্ট্রনীতির স্তম্ভ বানিয়ে নেয়। অপরদিকে, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে দেখে আসছে।.

এই দ্বন্দ্ব শুধু বাগযুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকেনি—প্রক্সি গোষ্ঠী যেমন হিজবুল্লাহ, হামাস, ইসলামিক জিহাদের মাধ্যমে একে অপরকে চেপে ধরার প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে।.

টাইমলাইন: ইরান–ইসরায়েল সংঘাতের সাম্প্রতিক ধারাবাহিকতা; উত্তেজনার গাঢ় ছায়া

২০২৩–২০২৫ সময়কালের প্রধান ঘটনা

২০২৩ (অক্টোবর-ডিসেম্বর): যুদ্ধের ছায়া ঘনাতে থাকে 

অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২৩: হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আকস্মিক হামলা চালায় (গাজা যুদ্ধের সূচনা)। ইরান হামাসকে সমর্থনের কথা অস্বীকার করলেও কূটনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়ে যায়। ইসরায়েল গাজায় হামলা বাড়ায়। ইরান-পন্থী মিলিশিয়ারা লেবানন ও ইরাক থেকেও সক্রিয় হয়।

২০২৪ (জানুয়ারি–জুন): মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার বিস্তার

ফেব্রুয়ারি ২০২৪: সিরিয়ায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইরানপন্থী কমান্ডার নিহত।.

মার্চ ২০২৪: হিজবুল্লাহ ও হুথি বিদ্রোহীরা নতুন করে সক্রিয় হয় এবং তাদের মাধ্যমে নতুন হামলার ঢেউ শুরু হয়।.

মে ২০২৪: ইসরায়েল ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানপন্থী মিলিশিয়াদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালায়।.

২০২৫ (এপ্রিল): উত্তেজনার চূড়ান্ত মুহূর্ত

৩ এপ্রিল ২০২৫: দামেস্কে ইরানিয়ান কনসুলেটের পাশে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় IRGC’র শীর্ষ জেনারেল নিহত।.

৫ এপ্রিল ২০২৫: ইরান ঘোষণা করে “উচিত জবাব” আসছে।.

১৩ এপ্রিল ২০২৫: ইতিহাসে প্রথমবার, ইরান সরাসরি ইসরায়েলকে লক্ষ করে ২০০টির বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। অধিকাংশ প্রতিহত হলেও, ইসরায়েলের দক্ষিণে কিছু ক্ষতি হয়।.

১৬ এপ্রিল ২০২৫: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স উভয়পক্ষকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানায়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২% বেড়ে যায়।.

২০ এপ্রিল ২০২৫: উত্তেজনার ধারাবাহিকতা অব্যাহত। ইসরায়েল ইরানের ভূভাগে ঘাঁটি লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালায়। ইরানের সেনাবাহিনী পূর্ণ প্রস্তুতি ঘোষণা করে। সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে ইরানপন্থী মিলিশিয়ারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিশ্বজুড়ে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে।

১২-১৬ জুন ২০২৫: ইজরায়েল “অপারেশন রাইজিং লায়ন” নামে পৃথক অভিযান চালিয়ে ইরানের মুল পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলোতে আকাশ ও ড্রোন হামলা চালায়। এতে ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার, পরমাণু বিজ্ঞানী ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কেন্দ্র ধ্বংস হয়। ইজরায়েলের দাবি দুই শতাধিক বিমান ও ড্রোন একশো লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমন করে। জবাবে ইরান সহস্রাধিক ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এরপর থেকে শুরু হয় ইজরায়েল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে প্রধান শহরগুলো (তেল আবিব, হাইফা, পেতাহ তিকভা) লক্ষ্য করে ইরানের বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। গত চারদিন ধরে যুদ্ধ চলছে ইরান-ইজরায়েল।

বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া: এক ঝড়ো ভবিষ্যতের ইঙ্গিত

জাতিসংঘ জরুরি বৈঠকে সংঘাত নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানায়।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে থাকলেও সরাসরি সংঘাতে জড়ায়নি।
রাশিয়া ও চীন উত্তেজনা প্রশমনে কূটনৈতিক সমাধান চায়।
তেলের বাজার ব্যারেলপ্রতি ১২-১৫% মূল্যবৃদ্ধি দেখে। হরমুজ প্রণালীতে অস্থিরতা বিশ্ব অর্থনীতিতে চাপ বাড়িয়েছে।.

ঝুঁকির মাত্রা: স্থানীয় যুদ্ধ না বৈশ্বিক সংকট?

পরমাণু ভয়াবহতা: ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও ইসরায়েলের সন্দেহভাজন পরমাণু অস্ত্র মজুদের কারণে উত্তেজনা বাড়ছে। যদিও সরাসরি পরমাণু হামলার হুমকি এখনো আসেনি, কিন্তু আঞ্চলিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা উদ্বেগজনক।.

প্রক্সি থেকে সরাসরি যুদ্ধ: গাজা, লেবানন, ইয়েমেন, এমনকি ইরাক ও সিরিয়ায় সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল। তুরস্কের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানও নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।.

মানবিক বিপর্যয়: পাল্টা হামলার ভয়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উদ্বাস্তু সমস্যা, শিশু-মৃত্যু ও বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বাড়ছে।.

FactCheck: তথ্য বনাম গুজব

দাবি.

সত্যতা.

বিশ্লেষণ.

ইরান এই প্রথম সরাসরি ইসরায়েলকে আক্রমণ করেছে.

✔ সত্য.

১৩ এপ্রিল ২০২৫ এ হামলা ছিল প্রথম সরাসরি সামরিক আঘাত.

সব ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করা গেছে.

✘ মিথ্যা.

আয়রন ডোম কার্যকর হলেও কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে.

পারমাণবিক যুদ্ধ আসন্ন.

⚠ অতিরঞ্জন.

এখনো কোনো পক্ষ পরমাণু ব্যবহারের হুমকি দেয়নি.

হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তেলের দাম দ্বিগুণ.

✔ বাস্তবসম্মত.

বিশ্ব তেলের ২০% আসে এখান দিয়ে.

 .


 .

উত্তরণ কীভাবে সম্ভব?

১. আন্তর্জাতিক কূটনীতি সক্রিয় করতে হবে: জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসি’র ভূমিকা জোরদার হওয়া জরুরি।.

২. যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বৈত চাপ: দুই পরাশক্তির যৌথ প্রয়াস মধ্যপ্রাচ্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।.

৩. আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সংলাপ: সৌদি আরব, তুরস্ক, কাতার—এই দেশগুলোর মধ্যস্থতা গুরুত্বপূর্ণ।.

৪. পারমাণবিক স্বচ্ছতা বাড়ানো: IAEA পর্যবেক্ষণ ও পারমাণবিক চুক্তির (JCPOA) পূর্ণ কার্যকরিতা নিশ্চিত করা দরকার।.

উপসংহার: আগুনে হাত দিলে সবাই পোড়ে

ইরান–ইসরায়েল সংঘাত কোনো দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধ নয়; এটি এক আন্তর্জাতিক অনির্বাচনীয় বিপর্যয়ের পূর্বাভাস। শুধু যুদ্ধজাহাজ বা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে নয়—এই সংঘাত চলছে আদর্শ, আধিপত্য ও অস্তিত্বের প্রশ্ন ঘিরে।.

বিশ্ব এখন এমন এক মোড় ঘুরিয়েছে যেখানে একটা ভুল সিদ্ধান্ত পুরো মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ পাল্টে দিতে পারে।
 .

তাই, এখনো সময় আছে—এই আগুন নেভাতে হলে কূটনীতি, সংলাপ আর মানবিকতাই হতে হবে মূল অস্ত্র।.

 .


 .

✍️ লেখক পরিচিতি:
শফিউল বারী রাসেল, কবি, গীতিকার, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
. .

ডে-নাইট-নিউজ /  শফিউল বারী রাসেল

সম্পাদকীয় বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ