রাজনীতির নতুন মোড়: পদত্যাগ, যোগদান ও অস্বস্তিকর প্রশ্ন.
=================================.
গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান দল থেকে পদত্যাগ করে বিএনপিতে যোগদান এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারার পদত্যাগ—এই দুই ঘটনা আলাদা মনে হলেও, রাজনীতির মানচিত্রে একে অপরের সাথে অদ্ভুতভাবে যুক্ত হয়ে গেছে। এই পদত্যাগগুলো নিছক ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, নাকি এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের জমে থাকা রাজনৈতিক অস্বস্তি, কৌশলগত ব্যর্থতা কিংবা আরও গভীর কোনো দুরভিসন্ধি—এই প্রশ্ন এখন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।.
.
প্রশ্ন উঠছে—এগুলো কি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত, নাকি পুরনো রাজনীতির নতুন মুখোশ?.
.
রাশেদ খানের সিদ্ধান্ত: আদর্শ বনাম বাস্তবতাঃ রাশেদ খান গণ অধিকার পরিষদের অন্যতম পরিচিত মুখ। ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা মাঠের আন্দোলনে পরিচিত একজন নেতা হিসেবে তাঁর একটি গ্রহণযোগ্যতা ছিল। এমন একজন নেতা হঠাৎ দল ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেবেন—এটা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তৈরি করে।.
.
প্রথম প্রশ্ন—তিনি কি আদর্শিকভাবে বদলে গেছেন? নাকি তিনি বুঝেছেন, ছোট দল বা বিকল্প রাজনীতির জায়গা থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রভাব ফেলা বাস্তবসম্মত নয়?.
.
বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতা হলো—ক্ষমতার কেন্দ্র এখনো মূলত দুই বৃহৎ রাজনৈতিক বলয়ের হাতেই। যারা দীর্ঘদিন ধরে “বিকল্প রাজনীতি” বা “তৃতীয় শক্তি”র কথা বলে আসছিলেন, সময়ের সাথে সাথে তাদের অনেকেই বাস্তবতার দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছেন। রাশেদ খানের পদত্যাগ সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন কি না, সেটি গভীরভাবে ভাবার বিষয়।.
.
বিএনপির জন্য এটি কী বার্তা বহন করেঃ বিএনপির জন্য রাশেদ খানের যোগদান একদিকে নতুন শক্তি, অন্যদিকে নতুন চ্যালেঞ্জ।.
.
শক্তি এই অর্থে—তিনি তরুণ, আন্দোলনমুখী এবং ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। চ্যালেঞ্জ এই অর্থে—.
বিএনপি কি তাকে কেবল “সংখ্যা বাড়ানোর” উপাদান হিসেবে ব্যবহার করবে, নাকি আদর্শিক ও সাংগঠনিক জায়গায় তাকে জায়গা দেবে?.
.
যদি নতুন মুখদের শুধুই শো-পিস বানানো হয়, তাহলে এই যোগদান খুব দ্রুত হতাশায় রূপ নিতে পারে—যেমনটা অতীতে অনেক ক্ষেত্রে হয়েছে।.
.
এনসিপি ও তাসনিম জারা: নীরবতা কি ব্যর্থতার লক্ষণ?ঃ এনসিপি থেকে তাসনিম জারার পদত্যাগ আরও এক ধাপ গভীর প্রশ্নের জন্ম দেয়। এনসিপি নিজেদের উপস্থাপন করেছিল “নতুন রাজনীতি”, “নীতিনিষ্ঠ রাজনীতি” এবং “বুদ্ধিবৃত্তিক বিকল্প” হিসেবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—সেই রাজনৈতিক কাঠামো কি আদৌ টেকসই ছিল?.
.
তাসনিম জারা কেন সরে দাঁড়ালেন? দল কি তার মত প্রকাশের জায়গা দিতে পেরেছিল? নাকি দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছিল কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ?.
.
অনেক সময় নতুন রাজনৈতিক দলগুলো মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও ভেতরে ভেতরে তারা পুরনো কাঠামোর পুনরাবৃত্তি করে। নেতৃত্বের সংকীর্ণতা, সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার অভাব এবং মাঠপর্যায়ে সংগঠনের দুর্বলতা—এই তিনটি কারণেই সাধারণত এমন দলগুলো ভেঙে পড়ে।.
.
দুই দলের ব্যর্থতা কোথায়?ঃ এই দুটি পদত্যাগ আমাদের একটি বড় প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়—নতুন বা বিকল্প রাজনৈতিক দলগুলো কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে?.
.
কিছু সম্ভাব্য কারণ নিন্মে তুলে ধরা হলো—.
১. মাঠের রাজনীতির অভাবঃ ফেসবুক লাইভ, টকশো আর বিবৃতির রাজনীতি দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি দল গড়া যায় না।.
.
২. নেতৃত্বের এককেন্দ্রিকতাঃ ভিন্নমতকে সহ্য না করার প্রবণতা দল ভাঙনের বড় কারণ।.
.
৩. স্পষ্ট আদর্শিক রোডম্যাপের অভাবঃ ‘আমরা ভালো’ বলা যথেষ্ট নয়—কীভাবে ভালো, সেটা দেখাতে হয়।.
.
৪. জনসম্পৃক্ততার ঘাটতিঃ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন দুঃখ-কষ্টের সাথে সংযোগ না থাকলে রাজনীতি টেকে না।.
.
কোনো দুরভিসন্ধি কি আছে?ঃ এখানেই সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রশ্নটি আসে—এর পেছনে কি কোনো অদৃশ্য হাত বা কৌশল কাজ করছে?.
.
সরাসরি কোনো অভিযোগ করা যায় না, তবে ইতিহাস বলে—বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় দলগুলো প্রায়ই ছোট দল ভাঙার সুযোগ নেয়। কেউ কেউ এটাকে রাজনৈতিক কৌশল বলেন, কেউ বলেন নৈতিক পতন।.
.
এই পদত্যাগগুলো যদি ধারাবাহিক হয়, যদি একই দিকে যায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ জাগে—এটা কি স্বতঃস্ফূর্ত, নাকি পরিকল্পিত?.
.
এর প্রভাব রাজনীতিতে পড়বে কি?ঃ স্বল্পমেয়াদে হয়তো বড় কোনো গণআন্দোলন বা বিস্ফোরণ হবে না। তবে দীর্ঘমেয়াদে কয়েকটি প্রভাব স্পষ্ট—.
.
১. বিকল্প রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা আরও দুর্বল হবে;.
.
২. বড় দলগুলো আরও শক্তিশালী হবে; .
.
৩. তরুণদের রাজনীতিতে আসার আগ্রহ কমতে পারে; এবং .
.
৪. “সবাই শেষ পর্যন্ত একই জায়গায় যায়”—এই হতাশা বাড়বে।.
.
উচ্ছৃঙ্খলতার আশঙ্কা কি আছে?ঃ সরাসরি সহিংসতা না হলেও, অনলাইন ও সামাজিক পরিসরে বিভ্রান্তি, গুজব এবং কাদা ছোড়াছুড়ি বাড়তে পারে। কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চাইবে—এটা অস্বীকার করা যায় না।.
.
তাই দায়িত্বশীল আচরণ সবচেয়ে জরুরি—নেতা, কর্মী এবং সমর্থক—সবারই।.
.
পরিশেষে বলতে চাই, এই পদত্যাগগুলো আমাদের আনন্দ বা উল্লাসের বিষয় হওয়া উচিত নয়, আবার অন্ধ ক্ষোভের কারণও নয় বরং এগুলো আত্মসমালোচনার সুযোগ।.
.
প্রশ্নটা ব্যক্তি নয়—প্রশ্নটা কাঠামো, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক চর্চা নিয়ে। যদি নতুন রাজনীতি সত্যিই গড়তে হয়, তাহলে পুরনো অভ্যাস ভাঙতেই হবে।.
.
না হলে ইতিহাস বারবার একই প্রশ্ন করবে—নতুন মুখ এলো কিন্তু রাজনীতি কি বদলালো?.
.
ভাববার সময় এখনই।.
.
লেখক: শফিউল বারী রাসেল (কবি, গীতিকার, সাংবাদিক, প্রবন্ধিক এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষক) .
. .
ডে-নাইট-নিউজ /
আপনার মতামত লিখুন: