
গরিবের হক লুটে নিলেন প্যানেল চেয়ারম্যান: ভিজিডির তালিকায় স্ত্রী, ভাগনি, মামি-খালা সবাই!.
.
জয়পুরহাট প্রতিনিধি : গরিবের হক কেড়ে নেওয়ার এমন নির্লজ্জ কাণ্ডে স্তব্ধ পুরো এলাকা। সরকারের দরিদ্র ও অসহায় নারীদের জন্য বরাদ্দকৃত ভিজিডি কর্মসূচি—যা দরিদ্র নারীদের জীবনে একটু স্বস্তি এনে দেওয়ার কথা—সেই কর্মসূচির তালিকাতেই জায়গা করে নিয়েছেন প্যানেল চেয়ারম্যানের স্ত্রী, ভাগনি, মামি, খালা, চাচি ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা।.
.
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার বড়তারা ইউনিয়নের ৩ নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। অভিযোগ উঠেছে, তিনি ও পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিলে সরকারি এই কর্মসূচিকে পরিণত করেছেন ‘আত্মীয়তার প্যাকেজ ও টাকার ব্যবসায়’।.
.
গরিবের কান্না আর টাকার কারসাজি:
স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই ইউনিয়নে ভিজিডি তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জনপ্রতি ২ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়েছে। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর আবারো প্রতিটি নামের বিপরীতে আদায় করা হয় অতিরিক্ত ১০০ টাকা।.
.
গ্রামের লোকজন বলছেন, পুরো প্রক্রিয়ায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম।.
অভিযোগের খাতায় শফিকুল ইসলামের নাম নতুন নয়। স্থানীয়রা বলছেন, তার কাছে ওয়ারিশ সনদ, জন্মনিবন্ধন, এমনকি সুপারিশপত্রও টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায়।.
আত্মীয়দের রাজত্ব তালিকায়:
তদন্তে জানা গেছে, শফিকুল ইসলামের নিজ ওয়ার্ড বড়তারা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ভিজিডি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ৫৩ জনের নাম। এর মধ্যে রয়েছেন তার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা (নম্বর ১৯১), দুই ভাবি মাফুজা খাতুন ও সেলিনা খাতুন (নম্বর ২১২ ও ২১৩), মামি খোতেজা খাতুন (নম্বর ২১০) তিন চাচি রিমা বেগম, আলেয়া বেগম ও আমেনা বেগম (নম্বর ২১৪-২১৭) খালা শেফালী বেগম (নম্বর ১৮২) এমনকি চিকিৎসক ভাগনিও!.
.
.
অথচ এই আত্মীয়দের অনেকেরই রয়েছে ৬–৮ বিঘা ফসলি জমি, পাকা বাড়ি, পুকুর ও ব্যবসা-বাণিজ্য। অন্যদিকে প্রকৃত দরিদ্র নারীরা দিনের পর দিন খালি পেটে ঘুমায়, চালের কার্ডের আশায় দৌড়ায় ইউনিয়ন অফিসে।.
.
আমি গরিব, তবু টাকা না দিলে নাম ওঠে না:
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সুবিধাভোগী জানালেন তার কান্নাভেজা গল্প— “আমার স্বামী নাই, দুই সন্তান নিয়ে অনেক সময় না খেয়ে থাকি। তাও তিন হাজার টাকা দিয়েছি ভিজিডির কার্ডের জন্য। এখন শুনছি তালিকায় আমার নামই নাই। ওর (শফিকুল) বিচার করবে আল্লাহ।”.
স্থানীয় বাসিন্দা মহসিন আলী ক্ষোভভরে বলেন, “শফিকুল আওয়ামী লীগের লোক। তবু কোন সাহসে এখনো টাকা খাচ্ছে? দরিদ্রের হক কেড়ে নিচ্ছে? কোন মুখে ধর্ম আর দলীয় স্লোগান দেয়! এরা আসলে সমাজের কলঙ্ক।”.
আরেকজন কৃষক জাহিদুল ইসলাম বলেন, “চাল বিতরণের দিনে লাইনে দেখি শুধু প্যানেল চেয়ারম্যানের আত্মীয়দের ভিড়। গরিবরা থাকে বাইরে দাঁড়িয়ে। পরে তার বড় ভাই সেই চালগুলো আবার কম দামে কিনে নেয়। কেউ কিছু বললে ঝগড়া হয় অফিসের ভেতরেই।”.
প্রশাসনের তদন্তে আত্মীয়প্রীতির প্রমাণ:
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা লায়লা নাসরিন জাহান নিশ্চিত করেছেন, “তদন্তে প্রমাণ মিলেছে শফিকুল ইসলাম তার স্ত্রী ও ভাগনির নাম ভিজিডি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন মিথ্যা তথ্য দিয়ে। তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অন্য আত্মীয়দের নাম থাকলে তা যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”.
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আল জিনাত বলেন, “নীতিমালা অনুযায়ী তালিকা তৈরি হয়েছে। যদি কেউ আত্মীয়প্রীতি বা ঘুষের মাধ্যমে নাম অন্তর্ভুক্ত করে থাকে, আমরা তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। এখনো লিখিত অভিযোগ পাইনি, তবে অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”.
অভিযুক্তদের পাল্টা যুক্তি:
অভিযুক্ত প্যানেল চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “তালিকা তৈরি করেছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, আমি শুধু সহায়তা করেছি। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”.
অন্যদিকে ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, “আমরা সহযোগিতা করেছি মাত্র। তালিকায় শফিকুলের ভাগনির নাম ছিল, তবে স্ত্রীর নাম ছিল না। জনপ্রতিনিধির দরিদ্র আত্মীয় থাকতেই পারে, তারা কি তাহলে সরকারি সুবিধা পাবে না?”.
মানুষের প্রশ্ন: এই দুর্নীতির বিচার কে করবে?:
গ্রামের মানুষের একটাই প্রশ্ন—সরকারের সবচেয়ে দরিদ্র নারীদের জন্য প্রণীত ভিজিডি কর্মসূচি যদি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিজস্ব ব্যবসাতে পরিণত হয়, তবে সমাজে ন্যায়বিচার কোথায়?.
বৃদ্ধা হামিদা বেগমের মতো অনেক নারী আজও খালি পেটে আশায় বসে আছেন— “কার্ড পাইনি, প্রতিদিন ভাত জোটে না। চেয়ারম্যানরা যদি এমন হয়, তাহলে আল্লাহই তাদের বিচার করবেন।”.
এটি একটি ইউনিয়নের দুর্নীতির গল্প—বাংলাদেশের প্রান্তিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। যেখানে ক্ষমতা মানে সুযোগ, আর গরিব মানে উপেক্ষিত এক নামহীন মুখ। ভিজিডির কার্ড শুধু এক মুঠো চাল নয়—এটি দরিদ্র নারীর জীবনের অস্তিত্বের প্রতীক। সেই প্রতীকে যখন দুর্নীতির দাগ লাগে, তখন রাষ্ট্রের বিবেকও নীরবে কাঁদে।.
ডে-নাইট-নিউজ /
আপনার মতামত লিখুন: